অতঃপর আমরা
শীতের রাতে ইস্টিমারে যাচ্ছিলাম অজানার খোঁজে।ইস্টিমারে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙতে দেখি ইস্টিমার হয়তো বড় কোনো একটা নদীর মাঝমাঝি অবস্থান করছে । চোখ দুটো কেমন জানি জ্বলছে আজ খুব। ভাবলাম একটু ফ্রেশ হয়ে নেই হয়তো ভালো লাগবে। ফ্রেশ হয়ে ইস্টিমারের একদম সামনের দিকে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতেই হঠাৎ আমার মনে হলো বৃষ্টির কথা। বৃষ্টি আর আমি যখন ফোনে কথা বলতাম ও যেন কি করে রোজ বুঝে ফেলতো যে আমি সিগারেট ধরাচ্ছি।ও বলে উঠতো রোদ তুমি সিগারেট ধরালে মাত্র তাই না। বলেছি না সিগারেট কম খাবে আর আমার সাথে কথা বলার সময় তো খাবেই না।তাও তুমি আমার কথা শুনবে না । আমি তখন একটু অবাক হাসি হেসেই বলতাম কি করে পারো তুমি। আজ বৃষ্টির কথা খুব মনে পড়ছে। এখন আর রোজ আমাদের কথা হয় না। আগে আমি ভুলে গেলেও বৃষ্টি ভুলতো না ফোন দিতে। ও রোজ আমায় ফোন দিতো।এখন আর দেয় না।হয়তো নিষেধ আছে।খয়েরী আর সাদা রং ভীষণ পছন্দ ছিলো বৃষ্টির। একবার কি হয়েছে ও একটা সাদা থ্রি পিজ বানিয়েছিলো ।আমাকে দেখিয়ে বলছে বলছে রোদ কেমন হয়েছে?কেমন লাগছে আমাকে?আমি কিছু না ভেবেই ধুম করে বলে ফেললাম তোমাকে সাদা রঙয়ে একদম বাজে লাগে।তার মনটা যে এতে খারাপ হয়েছিলো তা আমি বেজায় বুঝতে পেরেছিলাম তার কণ্ঠে।আমার মনে আছে আমাকে দোয়া ওর প্রথম টি শার্ট টা খয়েরী রঙের ছিলো।আমি প্রায়ই পড়ে থাকতাম ওর দেয়া টি শার্ট টা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বৃষ্টি আর আমার মধ্যে দেখা হয়েছিলো গুটি কয়েকবার তাও বন্ধুদের সাথে আড্ডা কিংবা অন্যকারও সাথে।একাকী কখনো তার সাথে আমার আলাপ হয়নি দুদন্ড। আমরা দুজনই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তাই জীবনের লক্ষ্য ছিলো কিছু একটা হতে হবে।দুজনের গন্তব্য ছিলো ভিন্ন। আমাকে ও ভীষণ বুঝতো কিন্তু আমি পুরোটা কখনো ওকে বুঝতে দিতাম না। ও নিজেকে আড়াল করতে পারতো না মোটেই। তাই আমি ওকে পুরোটাই বুঝতে পারতাম হয়তো অতিসহজেই। না হয় কখনোই হয়তো বুঝেই উঠতে পারিনি তাকে। কোনোকিছু এদিক ওদিক হলেই কেঁদে ফেলতো। সবকিছুতে ওর ছিলো খুব তাড়াহুড়ো। হাজারটা প্রশ্ন আর খামখেয়ালিপনা।না বুঝেই নিজের মনের মতো করে ভাবা।এই সবগুলো ছিলো তার রোজকার অভ্যাস। এই অভ্যাসগুলো সবসময় ওকে খুব কষ্ট দিতো। ও কষ্ট পেলে আমার খুব খারাপ লাগত তাই আমি ওকে এই সবের জন্য প্রায়ই বকাঝকা করতাম । না এখন আর স্টিমারের এদিকটাতে থাকা যাচ্ছে না প্রচন্ড শীত। হাত পা হিম হয়ে আসছে আমার।এককাপ চা না খেলেই হচ্ছে না এখন।চা খাওয়ার কথা মনে পড়তেই হাসি পায়,বৃষ্টির কতো কি যে স্বপ্ন ছিলো। আমাকে নিয়ে রিক্সা দিয়ে ঘুরবে মধ্যরাতে তারপর মোড়ের টংয়ের দোকানে আদা দিয়ে কড়া লিকারে চা খাবে তাও এই শীতের রাতে। আজ ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। একটা ফোন দিবো না থাক। কি ভাববে রাত তো অনেক হলো এখন। আজ চাঁদটা গোল একেবারে ঝলসানো রুটির মতো। কি যে দিপ্তীময় হাসি হেসে জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে। মনে আছে আমার একদিন রাত ২/৩ টা নাগাত হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো আমার। আমি তখন এসাইনমেন্ট শেষ করে ঘুমোতে যাব। ফোন ধরতেই কি এক উৎচ্ছাসি কণ্ঠে বলে উঠলো শোনো শোনো জানালাটা খুলে বাহিরে চেয়ে দেখো না একটু প্লিজ।আজ চাঁদটাকে কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে! জ্যোৎস্নার আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে আছে আজ। আমি তেমন একটা আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম বাদ দাও এখন ঘুমোতে হবে সকাল আটটায় ক্লাস। ও তখন অনেকটা কষ্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো। আচ্ছা ঠিক আছে। শুয়ে পড়ো। আবার ঠিক দু মিনিট পর হঠাৎ ফোন দিয়ে বললো দু মিনিট সময় হবে তোমার। আমি হেসে বললাম কি বলবে বলো। আমি যেদিন থাকবো না সেদিন তোমার ঐ চাঁদটাকে দেখে আমার কথা মনে পরবে দেখে নিও।আমি বললাম বৃষ্টি পাগলামী করো না ঘুমাও অনেক রাত হয়েছে আমাকে ঘুমাতে হবে।কথাটা শুনেই শেষ ফোনটা কেটে দিয়েছিলো অভিমানে।আমিও আর ফোন দেই নি। আজ ঠিক ওর কথাটাই সত্যি হলো। ও নেই কিন্তু ঐ চাঁদটা দেখে আমার ওর কথা মনে পড়ে।ওর বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগতো। আমার তেমন একটা ভালো লাগত না ব্যাপারটা। ও বলতো তোমার সাথে খোলা ছাদে বৃষ্টিজলে নৃত্য করব।আমি হাসতাম। আজকাল বৃষ্টিতে ভিজতে বড়ো ভালো লাগে আমার। মনে হয় আমি আর ও খুব কাছাকাছি আছি বৃষ্টিজলের মাঝে। ও বলত একদিন তুমি একাই ভিজবে আর আমাকে অনুভব করবে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটায়।ওর সবকথা কেনো সত্যি হচ্ছে আজকাল।মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের যা হয় আমারও তার ভিন্ন কিছু হলো না গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর স্বপ্ন পূরণের নেশায় মেতে উঠি আমি। বৃষ্টি রোজ ফোন দিতো আমায়।আমি হয় কেটে দিতাম না হয় রিসিভ করে খারাপ ব্যবহার করতাম।সেদিন ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে খুশীর দিন। আমার স্বপ্নপূরণের খবরটা পেয়েই ফোন দিয়েছিলাম বৃষ্টিকে। ও সেদিন ফোনটা রিসিভ করেনি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো রেগে আছে। তারপর দু তিন দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছিলো আমার। সুযোগ হয়নি খোঁজ নেয়ার।কিছুদিন পর আবার ফোন দিলাম কয়েকবার তাও ফোন ধরছিলো না সে। তখন আমি একটু রেগেই ওর একটা বোনের ফোন নাম্বার ছিলো আমার কাছে তাকে ফোন দিলাম।সে দু বার কল দেয়ার পর ধরলো।হ্যালো বলতেই চিনে ফেললো আমাকে।যদিও আগে দু একবার কথা হয়েছিলো তার সাথে। আমি বললাম বৃষ্টির ফোন কোথায়? ও কোথায়? দেখতে বলো আমি কতোবার তাকে ফোন দিয়েছি। ও বললো ভাইয়া আপু তো হসপিটালে। আমি কিছুটা স্তম্ভিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে ওর ? সে বললো ব্লাড ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ। আপনি আসবেন তো দেখতে।ও আপনাকে বলতে না করেছে বলেছে আপনাকে যেন না জানাই। আমি উত্তর না দিয়েই তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে যেমন ছিলাম তেমনি রওনা হলাম। পৌঁছে আমি তাকে পাইনি। সে ততোক্ষণে পাড়ি দিয়েছিলো ওপারে।পেয়েছিলাম হসপিটালের বেডে পরে থাকা নিস্তব্ধ শূন্য কায়া তার।তার সাথে কতো কথা ছিলো কিছুই বলা হলো না আর।ছুঁয়ে দেখা হলো না তার হাতখানা।অভিমানটা ভাঙানো হলো ননা আর।চিরদিনের মতো অভিমান নিয়েই আমাকে ছেড়ে গেলো সে।তার মুখটাও আমি শেষবারের মতো দেখতে পারিনি। আজও আমি ওকে রোজ দেখতে পাই ঝলসানো গোল চাঁদের দিপ্তীময় আলোয় পাশেই ছোট্ট একটা তারা হয়ে জ্বলছে। রোজ কথা হয় আমাদের। তবে এখন আর রোজ ফোন দেয় না সে আর আমার ফোনটাও পৌঁছায় না ওর কাছে। বড্ড অভিমানী মেয়েটা।এখনো অভিমানটা পুষে রেখেছে সে। একি চাঁদের আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে। ও ঐ যে পূবের আকাশে সূর্যের লাল আভা দেখা যাচ্ছে।ভোর হয়ে এলো।আজ আর কথা বলা হলো না আমাদের। এবার বৃষ্টির বিদায় নেয়ার পালা। আর আমার অপেক্ষার পালা শুরু। আবারও দেখা হওয়ার অপেক্ষায় পরে থাকবো নিঃসঙ্গ একাকী আমি,,,,,
No comments:
Post a Comment