লাল বাক্স

লাল বাক্স 

বাড়ির সামনে একটা লালরঙের চিঠির বাক্স ছিলো আমাদের সেখানেই পোস্টমাস্টার কাকু রোজ চিঠি ফেলে যেতেন। বাবার অফিসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রই আসতো সেখানে।আজকাল ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদানপ্রদান তো একদম অচল অবস্থা। বাবার চিঠিগুলো মূলত আমিই নিয়ে আসতাম বাক্স থেকে। সেদিন চিঠি আনতে গিয়ে আমি তো রীতিমতো আবাক। একি একটা খামের ওপরে প্রাপকের ঠিকানায় বড় বড় অক্ষরে লেখা অন্তি। এ যে আমার নাম। আমি তখন প্রেরকের নামটা লক্ষ্য করতেই দেখি কোন এক রূপম নামের ভদ্রলোকের নাম লেখা। আমি দৌড়ে গিয়ে ঐ চিঠিটা আমার ঘরে আলমারিতে লুকিয়ে রাখলাম। কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম এটা নিশ্চিত। তবে মনে মনে অসম্ভব কৌতুহল কাজ করছিলো। কখন বাবার চিঠিগুলো দিয়ে ঐ আগন্তুকের চিঠিটা পড়বো।বাবার চিঠিগুলো দিয়ে ঘরে এসে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে খামটা খুলে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলাম।
প্রিয়সু অন্তি,
আমি তোমাকে লাল গেলাপের শুভেচ্ছা দিবো না। আমি আমার পছন্দের একটা বেলি ফুলের মালা দিলাম তোমায় খোপায় জড়িয়ে নিয়ো। দেখো আমি কিন্তু তোমায় অন্তু বলেই ডাকবো। অবাক হচ্ছো তাই না। মনে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নিশ্চয়। আমি কে?কি আমার পরিচয়?তোমাকে চিনলাম কি করে?চিঠিই বা লিখছি কেনো তোমায়? হাসছো এখন নাকি বিরক্ত হচ্ছো।শোনো এবার আমার পরিচয়টা দিয়েই ফেলি। আমি রূপম।পড়াশুনা শেষ করে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছি চাকরির খোঁজে। থাকি ছোটখাটো একটা ছাত্র নিবাসে। কোনমতে দিন কাটে আমার। কয়েকটা টিউশনি করাই সেটা দিয়ে চাকরির খোঁজ, আবেদন,আর সারা মাস চলে আমার। ভাবছো এগুলো কেনো বলছি তোমাকে। কারণ আছে আজ বুঝবে না তবে একদিন ঠিক বুঝবে তুমি। অন্তু তোমাকে আমি চিনি না তবে তোমাকে দেখেছিলাম বাসস্টপে বাস থেকে নামছো নীলরঙের এক শাড়ি পরে। সেদিন তোমার পিছুপিছু এসে তোমার বাড়ির ঠিকানাটা পাই।একটু খোঁজ নিয়ে তোমার নাম আর তোমাদের এই লাল চিঠির বাক্সের কথা জানতে পারি তারপরই চিঠি লেখার বুদ্ধিটা মাথায় আসে আমার। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই কলমী বন্ধু। অন্তু এমন বলছি না যে আমাকে বন্ধু করতেই হবে কিন্তু যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে আমার চিঠির উত্তর দিবে। কথা দিলাম আমরা শুধু চিঠিতেই কথা বলবো সপ্তাহে একবার। জানি না তোমার উত্তর পাবো কিনা। যাই হোক না কেন ভালো থাকো সবসময়। বিদায় তোমার চিঠির অপেক্ষায়।
ইতি
রূপম
চিঠিটা পড়তে পড়তে হতবাক হয়েছি বারবার। মাঝেমাঝে খুব হাসিও পেয়েছে। তার কথাগুলো খুব স্পষ্ট ভাষায় লেখা তাই কিছুটা ভালোও লেগেছিলো সেদিন। সারারাত সেদিন বহুবার পড়েছিলাম চিঠিটা। মনের মধ্যে কতো কি ঘুরপাক খাচ্ছিলো সেদিন। এমন করে সাত দিন কেটে গেলো। আজ স্থির করেই ফেললাম চিঠির উত্তর দিবো। সেদিন রাতে সারারাত ধরে চিঠির উত্তর লিখেছিলাম তাকে। আমার লেখার হাত তেমন একটা পাকা ছিলো না। তাও লিখলাম। বর্তমান এই যুগে হাতে লিখে চিঠি পেয়েছিলাম বন্ধু হওয়ার নিমন্ত্রণ তাই হয়তো আগ্রহটা ছিলো অন্যরকম। তার বন্ধু হওয়ার ইচ্ছেও ছিলো ভীষণ। সেদিন ঘুমাইনি রাতে। কখন ভোর হবে সেই অপেক্ষায় । ভোর হতেই চিঠিখানা নিয়ে ছুটেছিলাম পোস্ট অফিসে। আগে কখনো পোস্ট অফিসের ঠিকানাও জানতাম না তাই একটা রিক্সা নিয়ে পৌঁছে গেলাম পোস্ট অফিস। গিয়ে চিঠিখানা দিয়ে আসতে আসতে ভাবছিলাম এর উত্তর কবে আসবে।সেদিন ভোরে রূপম চিঠিখানা পেয়ে। প্রথমদিকে খানিকটা অবাক হলেও মনে মনে সে জানি জানত চিঠির উত্তর আসবেই। তারপর হলুদ খামের আড়ালে সাদা কাগজের চিঠি খানা বের করে বিছানায় শুয়ে পড়তে শুরু করল। মেয়েটা হাতের লেখাগুলো বড় বড় রসগোল্লার মতো চেয়ে আছে পুরো কাগজ জুড়ে। অন্তু তাকে উত্তর দিয়েছে আমাদের মধ্যে চিঠি আদানপ্রদানেই কথা হবে। আমরা দেখা করব না, ফোনে কথা বলব না কিংবা অন্য কোনো যোগাযোগব্যবস্থার ব্যবহার করব না। সপ্তাহে আমরা দুজন দুজনকে একটা করে চিঠি লিখবো। সারা সপ্তাহ জমে থাকা কথাগুলো উঠে আসবে আমাদের লেখনিতে।আপনি হয়তো হাসছেন তাই না একটা মেয়েকে চিঠি দিয়ে বন্ধু হওয়ার নিমন্ত্রণ দিলাম অমনি সে রাজি হয়ে গেলো। হ্যাঁ আমি আপনার কলমী বন্ধু হতে চাই কারণ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকম।আমার পরিচয়টা ততো বিশেষত্ব নেই।আমি অন্তি। বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা।অবশ্য আমার একটা ছোট ভাইও আছে। সে পড়াশুনার জন্য শহরের বাহিরে থাকে। বাবা মা আর আমিই থাকি বাসায়।আমি বাংলাতে অনার্স করতেছি। শেষ বর্ষ চলছে।প্রথম চিঠিতে সে রূপমকে তেমন কিছুই জানায়নি তার কথা।এরপর প্রতি সপ্তাহে রূপম আর আমি দুজনই অপেক্ষা করতাম কবে আসবে চিঠি।আমাদের চিঠিগুলো আকারে একটু বড়োই হতো কারণ সারা সপ্তাহের কথা লিখতাম দুজন দুজনকে।চিঠিতে দুজন দুজনার কল্পনা স্বপ্ন সব তুলে আনতাম মনের অতল থেকে।রূপম একটু বাস্তববাদী কল্পনাতে তার বিশ্বাস ছিলো না তাই আমার কল্পনাগুলোই ছিলো তার কল্পনা।রূপকে আমি সবসময় বলতাম,একটা ছবি দাও না আমি তোমাকে দেখবো। তুমি আমাকে দেখলে অথচ দেখো আমি কখনো তোমায় দেখলাম না। আমার কি দেখতে ইচ্ছে হয় না বলো। রূপ উত্তরে বলতো আমাকে আবার কি দেখবে। আমি দেখতে ভালো না। ছবি না একদিন আপাদমস্তক এসে হাজির হবো তোমার সামনে। অন্তু সেই আশা নিয়েই চুপ থাকতো। একবার প্রায় দু সপ্তাহের বেশী হয়ে গেছে রূপের একটাও চিঠি আসেনি। অন্তু ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলে। এই দু সপ্তাহের বেশীরভাগ সময়ই তার কেটেছে লালবাক্স দেখে। দু দুটো চিঠি দিয়েছে সে উত্তর আসেনি। সেদিন ছিলো সোমবার লালবাক্স খুলতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো অন্তু। চিঠিটা নিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে গেলো সে। তড়িঘড়ি করে খামটা খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করল। রূপ বারবার ক্ষমা চেয়েছিলো সেবার চিঠিটাতে। দুটো বড় বড় পাতায় চিঠি লিখেছিলো সে। ঐ দু সপ্তাহ ধরে সে হাসপাতালে ছিলো। টাইফয়েড নিয়ে পরেছিলো হাসপাতালের বেডে।মাথা নেড়ে একটু উঠেই তার চিঠি দুটো পড়ে অপেক্ষা না করে সেই ক্লান্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে উত্তর নিয়ে ছুটেছে এসেছিলো। এবার অন্তুর খুব খারাপ লাগছে নিজের কাছে।সে কতো অভিমান নিয়ে কতো কি যে লিখেছিলো ঐ দুটো চিঠিতে। অন্তু তাকে চিঠিতে বারবার নিজের শরীরের যত্ন নিতে বললো এবার উত্তরে।আর নিজের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলো।তাকে ভুল বুঝে সে যে ভীষণ লজ্জিত তা তার লেখনীতেই বুঝা গেলো।সময় মতো খাবে,ভালো খাবার খাবে।অনিয়ম করবে না আরও কতো যে কি লিখেছিলো মা কিংবা বউয়ের মতো।এভাবে চিঠি দেওয়ানেওয়া, স্বপ্ন, কল্পনা,অপেক্ষা করতে করতে এক বছর কেটে যায় তাদের। একবছরে অনেককিছু পাল্টে গেছে দুজন দুজনার খুব আপন হয়ে উঠেছে। সেদিন রূপের চিঠিটা পেয়ে অন্তু ভীষণ খুশি রূপের স্বপ্ন সফল হয়েছে। ব্যাংকে চাকরিটা এবার তার হয়ে গেছে।চাকরির প্রথমমাসের বেতন পেয়ে রূপ অন্তুর জন্য একটা নীল রঙের শাড়ী কিনে পাঠিয়ে ছিলো। আর বলেছিলো প্রথম যেদিন দেখা হবে সেদিন এটাই পরবে তুমি। আর আমি আমার জন্মদিনে তোমার দেয়া বেগুনী রঙের পাঞ্জাবীটা পড়বো।এক বছর দুই মাস পাঁচ দিন পর তারা দেখা করবে এমন ঠিক হয়েছিলো। সেদিন শুক্রবার ছিলো। পথঘাট বেশ ফাঁকাই ছিলো। দেখা করার কথা ছিলো বিকেল ৪ টায়। কিন্তু দুজনই খুব তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছিলো। অন্তুর পড়নে নীল রঙের শাড়ী মাথায় কালো রঙের একটা হিজাব। আর রূপ বেগুনী রঙের পাঞ্জাবী সাথে কালো ট্রাউজার। চোখে চশমা। কথা ছিলো মেইনরোডের ওপাশে অপেক্ষা করবে রূপ তারপর কোথায় একটা যাবে দুজন মিলে। শাড়ী সামলাতে পাড়তো না অন্তু গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে দাড়ালো সিগনালে। ওপাশে অপেক্ষা করছিলো রূপ।বারবার রাস্তার ওপাশে তাকাচ্ছে অন্তু।এবার তার চোখে পড়লো কোনো এক যুবক তার দিকে হাত নাড়িয়ে কি যেন বলছে। ট্রাফিকপুলিশের বাঁশি আর গাড়ির হর্ণে কিছুই পৌছাচ্ছে না কান অবধি। তবে তার ঠোঁট নাড়ানো দেখে এটুকু বুঝা যাচ্ছে যে সে অন্তু বলেই ডাকছে।অন্তুর এবার আর বুঝতে বাকি রইলো না সে যে তার রূপ।সিগনালের অপেক্ষা না করেই সে পাড় হতে শুরু করলো রাস্তা।একে শাড়ী নিয়ে হাটতে পাড়ছিলো না তারপর রূপের দিকে তাকাতে গিয়ে সে খেয়াল করতে পারছিলো না অতোবড় ট্রাক তার দিকে ধেয়ে আসছে। ট্রাকের ড্রাইভারও তার গতি সামলাতে পারেনি। রূপের চোখে প্রচন্ড ভয় আর তার ঠোট নাড়ানো দেখে ঘাড় ফিরে তাকাতেই ট্রাকটা তাকে স্বজোড়ো ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো।রূপ ওপাশ থেকে দৌড়ে আসতে আসতে অন্তুর নীল শাড়ীর রঙ লাল হয়ে গেলো। মাথা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। হাসপাতাল অবধি যাওয়ার আগেই রূপের কোলেই সেদিন নিঃশব্দে নিরবতার সাথে ভাব করে নিয়েছিলো অন্তু।অবাক আর পাথরের মতো তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে ছিলো রূপ।আজও রূপ প্রতি শুক্রবার দাঁড়িয়ে থাকে সিগনালে। অপেক্ষায় থাকে অন্তুর।অনন্তকালের এ অপেক্ষার শেষ হবে না জেনেও সে অপেক্ষা করে।আর ট্রাফিকপুলিশকে তার কাজে সাহায্য করে। পথচারীদের সর্তক করে রাস্তা পাড়াপাড়ে।সপ্তাহের একটা দিন তার কাটে ট্রাফিক সিগনালেই।আর সিগনালে দাঁড়িয়ে অন্তুর সেদিনের হাসিমাথা মুখটা খুঁজে বেড়ায় হাজার মুখের ভীড়ে,,,,,,,,,,

No comments:

Post a Comment

অতঃপর হিমু